আইএমএফের শর্ত ও নিম্নবিত্তের কষ্ট

আইএমএফের শর্ত ও নিম্নবিত্তের কষ্ট

অর্থনীতি স্লাইড

মার্চ ১৩, ২০২৩ ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিভিন্ন ধরনের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত হচ্ছে বিভিন্ন খাতের ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো। অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ কমানো, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রদেয় মুনাফার ওপর আরও কর বৃদ্ধি ইত্যাদি। সরকার ভর্তুকি কমালে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। এতে করে সরকারের আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য আসবে ঠিকই; কিন্তু গরিব ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য বয়ে আনবে অমানবিক কষ্ট। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়াচ্ছে। বাড়াচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার ও তেলের দাম। ফলে বেড়ে যাচ্ছে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এমনিতেই করোনা মহামারির পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে এর প্রভাব দারুণভাবে পড়েছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এতে আমদানি পণ্যের মূল্য অনেকটাই বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

পণ্যের অসহনীয় মূল্যে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছেন ভোক্তা। চাল, ডাল, আটা, মাছ, মাংস, ডিম, সবজিসহ প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও বিক্রেতারা নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। পণ্যের এ বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষগুলো। খেতে পাচ্ছে না স্বাস্থ্যকর মানসম্মত খাবার। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গঠনেও। যে কোনো অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। কারণ, জবাবদিহিতা নেই কোথাও। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। সরকার দুস্থ ও নিম্নবিত্তের জন্য ওএমএস চালু করলেও এখানে স্বচ্ছতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। খোলাবাজারে এসব পণ্য বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দাম বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট ও বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এর ফলে এ শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সমন্বয় হচ্ছে না। যার যেটুকু সঞ্চয় ছিল, তা ভেঙে সংসারের খরচ নির্বাহ করছেন। ফলে ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। সঞ্চয় না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না; কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। শুধু তাই নয়, যাদের আয় কমে গেছে, তারা যে কী পরিমাণ আর্থিক দুর্দশায় পড়েছেন, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করছেন। সব মিলে এখন একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

সামনে পবিত্র রমজান। রমজান কেন্দ্র করে বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য এখনই আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে সেসব পণ্য, যেগুলো রোজাদাররা বাড়তি দামে হলেও স্বল্প পরিমাণে কিনবেন। রমজান কেন্দ্র করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা এ দেশে একটি চিরাচরিত নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। পবিত্র রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে বেশি বেশি নামাজ-রোজা কায়েম আর দান-খয়রাত করার কথা বলেছেন, তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। তার পরও সব কিছু জেনেশুনে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ মাসে সর্বাধিক মুনাফা লাভের আশায় রমজান শুরুর অনেক আগে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, এবারও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা করেও কোনো লাভ হয়নি এবং হচ্ছে না। এমনকি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কিংবা বাজার ব্যবস্থাপনারও কোনো উন্নয়ন ঘটছে না।

গত বছর জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরে বিশ্বব্যাপী চলমান মন্দা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। মন্দার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পাবে। বিনিয়োগ কমে যাবে। কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি দেখা দেবে। খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। কর্মসংস্থানের গতি কমবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। বেকারত্ব বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, সঞ্চয় কমবে; একই সঙ্গে হ্রাস পাবে বিশ্ববাণিজ্য। এতসব কিছু জানার পরও আইএমএফের শর্তসাপেক্ষ এ ঋণ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে বা অর্থনীতিকে কতটা গতিশীল করবে, তা ভাবার বিষয়।

নিম্নমধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা তাদের সংসারের দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য সঞ্চয়কৃত অর্থ কোথাও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে সেই অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন। সঞ্চয়পত্রের সেই মুনাফার ওপর সরকার বারবার খড়গ চালাচ্ছিল। এ নিয়ে বহু লেখালেখি, আবেদন-নিবেদন করে কোনো লাভ তো হয়নি, উপরন্তু এবার আইএমএফ সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রদেয় মুনাফার ওপর আরও কর বৃদ্ধি এবং সুদহার বাস্তবভিত্তিক করার প্রস্তাব দিয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাহলে বলির পাঁঠা কি শুধু এই শ্রেণিই হবে? অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, বড় বড় হেডলাইনে লেখা-‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়’। দেশের ব্যাংক খালি হচ্ছে আর সুইস ব্যাংকে জমছে টাকার পাহাড়। ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে টাকা ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ টাকার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান-২০২২ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। পত্রিকান্তরে আরও জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিভিন্ন কারণে বিত্তবানরা দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে বিভিন্ন উপায়ে টাকা পাচার হচ্ছে। বিগত ছয় বছরে দেশ থেকে চার লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি এ মুহূর্তে দেশের পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে জনগণকে একটু শান্তি আর স্বস্তিতে রাখার জন্য সরকারকে আরও বেশি আন্তরিক, উদ্যোগী ও মনোযোগী হতে হবে। উল্লেখ্য, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের চেয়ে আমরা এখনো ভালো অবস্থানে আছি। এ অবস্থানটা ধরে রাখতে হলে সরকারকে কঠোর হাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ, প্রতিটি অফিস-আদালতে কৃচ্ছ্রসাধন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষার্থে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ, জরুরি না হলে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ নিরুৎসাহিত করাসহ জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তা না হলে এমন পরিস্থিতিতে জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে, যা আমাদের জন্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনবে না। কাজেই সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে সরকারকে এগোতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *