অবৈধ ইটভাটা বাড়ছে: ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে সরকার

অবৈধ ইটভাটা বাড়ছে: ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে সরকার

জাতীয় স্লাইড

মার্চ ৫, ২০২৩ ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

সারা দেশে নির্বিঘ্নে চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা। কাগজে-কলমে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এর মধ্যে বৈধ ইটভাটা ৩ হাজার ৪০০টি। আর অবৈধ ইটভাটা ৪ হাজার ৬০০টি। পোড়া ইটের ব্যবহার কমিয়ে সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও কংক্রিটের ব্লকের প্রসার ও উন্নয়ন কাজে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের কার্যকর অগ্রগতি নেই। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের বৈধ ও অবৈধ ইটভাটায় বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ও পাহাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে। পাশাপাশি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারে প্রতিবছর নিধন করা হচ্ছে অসংখ্য গাছপালা। আর ইট পোড়াতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করায় সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক বায়ুদূষণ। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো স্থানে নিয়মবহির্ভূতভাবে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে এসব ভাটা। আর পোড়া ইটের বিকল্প হিসাবে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। বিশেষ করে সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে উৎসাহ নেই সংশ্লিষ্টদের। অথচ ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের সরকারি নির্মাণে এই ব্লক ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে। সেই হিসাবে চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কংক্রিটের ব্লকের প্রসার ঘটাতে সরকারের তৎপরতা না থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে ব্লক তৈরির জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে ধীরে ধীরে বেসরকারি পর্যায়ে ব্লকের ব্যবহার বাড়ছে। বেসরকারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কনকর্ড, সেল ও বিটিআই নির্মাণকাজে ব্লকের ব্যবহার শুরু করেছে। এছাড়া দেশের শহরাঞ্চলে ইটের পরিবর্তে মানুষ ব্লক ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেছে। দেশে সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রকল্প ভাসানচরের সব নির্মাণকাজে পোড়া ইটের বিকল্প হিসাবে ব্লকের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে স্বল্পপরিসরে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার শুরু করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, সরকারের নির্দেশনা রয়েছে পোড়া ইটের ব্যবহার কমিয়ে কংক্রিটের ব্লক বাড়ানোর। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না। ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার পর আবারও তৈরি করছে মানুষ। আমরা চিন্তা করছি, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে কঠোর নির্দেশনা দেওয়ার। তাতেও কতটুকু কাজ হবে জানি না।

এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, পোড়া ইটের বিকল্প হিসাবে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি উন্নয়ন কাজে শতভাগ কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব হবে না। তবে এখন কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের জোর তৎপরতা চলছে। সে কারণে আমরা আশা করছি, ২০২৭ সালে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের ইটভাটাগুলোতে বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ইট প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০০ কোটি ইট ভবন ও সড়ক উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৯০০ কোটি ইট ব্যবহৃত হচ্ছে ভবন নির্মাণে এবং সড়কে ব্যবহৃত হচ্ছে অন্তত ৮০০ কোটি ইট। এছাড়া প্রায় ৮০০ কোটি ইট পার্শ^বর্তী দেশ ভারতেও রপ্তানি করা হয়। পোড়া ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্লক নির্মাণ শুরু হয়েছে দেশে। ভবনে পাঁচটি ইটের বিপরীতে ১টি ব্লক যথেষ্ট। আর সড়কে প্রতিটি ইটের সমান আয়তনের হবে ব্লকগুলো। সে হিসাবে ভবন নির্মাণে ইটের চাহিদা পূরণে বছরে ১৮০ কোটি ব্লক দরকার। আর সড়কের উন্নয়ন কাজে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি ব্লক দরকার। অর্থাৎ বছরে মোট ইটের পরিবর্তে মোট ব্লকের চাহিদা হচ্ছে প্রায় ৯৮০ কোটি। অথচ এই মুহূর্তে ব্লক তৈরি হচ্ছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি। ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরে হিসাবে বলা হয়, সারা দেশে ইটভাটা ছিল ৪ হাজার ৯৫৯টি। আর ২০১৮ সালে এ প্রতিষ্ঠানটিই জানায়, দেশে ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯০২টি।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত) ২০১৮ অনুযায়ী আবাসিক, সংরক্ষিত ও বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর ও কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। ইটভাটা হতে হবে এসব এলাকা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে। এছাড়া পাহাড়ি এলাকা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এ আইনে আরও বলা হয়েছে, ইট প্রস্তুতের জন্য এ আইনে সংজ্ঞায়িত (বালি, মাটি বা অন্য কোনো উপকরণ দিয়ে ভাটায় পুড়িয়ে প্রস্তুতকৃত কোনো নির্মাণসামগ্রী) ইটভাটা ছাড়া অন্য কোনোরূপ ইটভাটা স্থাপন, পরিচালনা কিংবা চালু করা যাবে না। এসব ইটভাটা করতে জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। তবে ব্লক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইটভাটার দূষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য সারা দেশে ক্রমান্বয়ে ইটের বিকল্প ব্লক ও ছিদ্রযুক্ত ইট উৎপাদন ও সরকারি ইমারত নির্মাণকাজে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ইটের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার লক্ষ্যে টেন্ডার ডকুমেন্টসে ক্রমবর্ধমান হারে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে।

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ইট ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের টেন্ডার ডকুমেন্টসে ব্লক ব্যবহারের হার ১০ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শতভাগ নির্ধারণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারি উন্নয়ন কাজে ৬০ শতাংশ ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু কত শতাংশ নিশ্চিত হয়েছে। সে বিষয়ে এখনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশের ইটভাটাগুলোতে প্রতিবছর ২০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ ও ২০ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হয়। তাদের হিসাবে এ থেকে বছরে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয় প্রায় ৯০ লাখ টন। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা মনে করেন, দেশে পোড়া ইটের কোনো প্রয়োজন নেই। নদী থেকে ড্রেজিং করে যে বালু ও মাটি উত্তোলন হয়; তা দিয়েই পোড়া ইটের বিকল্প ব্লকের চাহিদা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্সের নির্বাহী পরিচলক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, পোড়া ইট পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য সরকার পোড়া ইটের বিকল্প হিসাবে ব্লকের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে আইনও পাশ হয়েছে। এ আইন মোতাবেক ২০২৫ সালে সরকারি সব কাজে পোড়া ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহার করার কথা। সে মোতাবেক চলতি বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬০ শতাংশ ব্লক ব্যবহার করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কত শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্মাণকাজে ইটের পাশাপাশি ব্লকের ব্যবহারের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের অদক্ষতা ও ব্লকের স্বল্পতার কারণে এটার ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এছাড়া ব্লক ব্যবহারে শ্রমিকদের দক্ষতা ও ব্লকের উৎপাদনও নিশ্চিত করতে হবে। এসব কাজে পিছিয়ে থাকলে পোড়া ইটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। নতুন করে ইটভাটার অনুমোদন না দেওয়ায় চাহিদা থাকায় অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

বাংলাদেশ কংক্রিট ব্লক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব প্রকৌশলী মো. বজলুর রহমান বলেন, কংক্রিটের ব্লকের প্রসার ঘটাতে হবে এবং বৈধ ও অবৈধ সব ইটভাটা বন্ধ করে দিতে হবে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছে। সেখানে আমরা এমন প্রস্তাব রেখেছি। সরকারকে এ বিষয়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *