নভেম্বর ১৯, ২০২৪ ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ‘গণহত্যা’ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দিতে এক মাস সময় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি সাবেক নয় মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে ‘গণহত্যার’ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এ আদালত।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলার মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনা একাই আসামি। আরেক মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৪৫ জন আসামি। ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
সোমবার প্রথমবারের মতো সাবেক সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এদিন সকাল ১০টার দিকে গ্রেফতার সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানি শুরু হয়।
প্রথম দিনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো তুলে ধরেন। শুনানিতে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরের শাসনামলে এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যেটা শেখ হাসিনা করেননি। তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা ছিলেন তার সহযোগী।
এদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিল কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকে আদালত ভবনের সামনে যেতে পারলেও সুনির্দিষ্ট পাশ ছাড়া এজলাস কক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আদালত কক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বেলা সাড়ে দশটার দিকে সাবেক সরকারের ১৩ মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীকে প্রিজন ভ্যানে করে বিভিন্ন কারাগার থেকে আদালত অঙ্গনে আনা হয়। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে তাদের আদালত কক্ষে কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। নিচে কাঠের রেলিং আর ওপরে কাচঘেরা কাঠগড়ার ভেতরে চেয়ারে বসে আদালত কার্যক্রম শোনেন আসামিরা।
দুই সারিতে বসা আসামিদের মধ্যে প্রথম সারিতে (ডানপাশ থেকে) শাজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, রাশেদ খান মেনন, লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক খান, আনিসুল হক ও তৌফিক ইলাহী চৌধুরী ছিলেন। তাদের পেছনে দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন (ডানপাশ থেকে) জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সালমান এফ রহমান, গাজী গোলাম দস্তগীর এবং হাসানুল হক ইনু। সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে কাঠগড়ার বাইরের পাশে একটি চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। অপর এক আসামি সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক অন্য মামলায় রিমান্ডে থাকায় আজ তাকে হাজির করা হয়নি।
বেলা ১১টায় বিচারকরা এজলাসে প্রবেশ করলে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতেই চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আসামি পক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীর বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সমাজী সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ পাঁচজনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওই আদালতে এসেছিলেন। তাজুল ইসলাম আদালতকে জানান, এহসানুল হক সমাজী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন এবং সে কারণে তিনি এখন আসামিদের পক্ষে দাঁড়ালে সেটি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। এ কারণে তিনি সমাজীকে শুনানি থেকে বিরত থাকার জন্য আদালতের মাধ্যমে অনুরোধ করেন।
এহসানুল হক সমাজী আদালতকে জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তখন তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলছেন এবং সরকারের দিক থেকে খুব শিগগিরই এটি জানানো হবে। তখন আদালত এহসানুল হক সমাজীর কাছে জানতে চান যে, তিনি এখন কী করবেন। জবাবে সমাজী বলেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু জানেন না এবং সরকারের দিক থেকে এমন কিছু এলে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। তারপরও চিফ প্রসিকিউটর যেহেতু বলছেন সে কারণে বিতর্ক এড়াতে ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তিনি শুনানি না করার কথা আদালতকে জানান। পরে আজিজুর রহমান নামে আরেকজন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে কথা বলবেন বলে জানান সমাজী। তবে তার আবেদন বিচারকরা হাতে না পাওয়ায় আজ তার বক্তব্য তিনি উপস্থাপন করেননি।
এরপর জুলাই-আগস্টের ঘটনায় গণহত্যার মামলার প্রথমটি নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তাজুল ইসলাম। এই মামলার একমাত্র আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে সব মানবতাবিরোধী অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা। এমন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেননি। আর উপস্থিত আসামিরা এসব অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করে গেছেন। গণহত্যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চেয়েছেন। তবে এসব অপরাধের বিচারিক প্রমাণ সংগ্রহে আরও সময়ের প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি আদালতের কাছে দুই মাসের সময় চান। আদালত এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন।
এরপর তাজুল ইসলাম দ্বিতীয় মামলায় শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্য এবং তার দলের নেতাসহ সাবেক কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উল্লেখ করে তদন্তের জন্য সময় চাইলে আদালত এক মাস সময় দেন। এ পর্যায়ে আদালত চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের কাছে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারি পরোয়ানার কী হলো জানতে চান। তাজুল ইসলাম আদালতকে জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে তারা জানতে পেয়েছেন তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতে পালিয়ে গেছেন। সেজন্য এখন ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া চলছে। এরপর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে সে অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে ভারতকে অনুরোধ জানাবে সরকার।
বিগত সরকারের কর্মকাণ্ডকে নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা : ট্রাইব্যুনালে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুধু জুলাই-আগস্ট মাসেই নয়, বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পরই গুম-খুন ও হত্যার বীভৎসতা সৃষ্টি করে। হিটলারের সময়ের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো ক্যাম্প তৈরি করে তাতে নিষ্ঠুরভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হয়েছে। তারা শুধু গণহত্যাই করেনি, নির্যাতনের যত রকম পন্থা রয়েছে সবই বাস্তবায়ন করেছে, যা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তাদের মধ্যকার ১৩ জনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আগামী দিনে যারা ফ্যাসিস্ট হতে চান, তাদের জন্য আজকের দিনটি এক শিক্ষার দিন। মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের মাধ্যমে একটি নিপীড়ক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল, সে স্টোরি আমরা আদালতে তুলে ধরেছি। একটি পরিবারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড, এছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। আজকের সব অপরাধের প্রধান দায় শেখ হাসিনার। জুলাই অভ্যুত্থানে ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে টার্গেট করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এর তদন্ত সমাপ্ত করে বিচারের উপযোগী একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম, আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করেছেন। এ সময় প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এম এইচ তামিম ও আবদুল্লাহ আল নোমান উপস্থিত ছিলেন।
আইনজীবী-স্বজনদের সাক্ষাতের অনুমতি : এদিকে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান দুলু জানান, সাবেক মন্ত্রীসহ আসামিদের সঙ্গে আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু আরও বলেন, আসামিদের অভিযোগের কপি যদি না পাই তাহলে কীভাবে ডিফেন্ট করব? ডিফেন্ট করার জন্য এবং আসামিদের নির্দোষ প্রমাণের জন্য বিধি অনুযায়ী আবেদন করেছি এবং আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আমরা অর্থাৎ আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সুশৃঙ্খলভাবে একজন করে কথা বলতে পারব এবং সেই আদেশটি আমরা পেয়েছি। আমরা সব আসামির সঙ্গেই কথা বলতে পারব। আসামিদের সঙ্গে কথা বলেছেন কি না সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, তৌফিক-ই-ইলাহী ও ফারুক খানের সঙ্গে কথা বলেছি।
বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা কামাল মজুমদারের : এদিকে আদালত চলার সময়ে কাঠগড়া থেকে একাধিকবার দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। কিন্তু তিনি নিচুস্বরে কথা বলায় তার আর্জি বিচারকদের দৃষ্টিতে আসেনি। ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেওয়ার মধ্যে তিনি আবার দাঁড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে তখন কাঠগড়ায় থাকা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আদালত আদেশ দিচ্ছে। আদেশের পর কথা বলবেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে বসিয়ে দেন। ট্রাইব্যুনালে হাজিরা শেষে কারাগারে যাওয়ার সময় আইনজীবীকে কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক ছিল। আমি কখনো এ আন্দোলনের বিরোধিতা করিনি। এছাড়া আন্দোলনের বিপক্ষে কোনো বক্তব্য দেইনি, বরং আমার টেলিভিশনের মাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছি। যখনই আমি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলার প্রতিবাদ করেছি সেদিন থেকে আমাকে গণভবনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে মামলার কার্যক্রম শেষ হলে আদালত আসামিদের সঙ্গে তাদের স্বজন ও আইনজীবীদের সাক্ষাতের অনুমতি দেন। এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারসহ বিচারকরা এজলাস ছেড়ে যান। পরে বেলা ১টা ২২ মিনিটের দিকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আবারও প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় গত আওয়ামী লীগ সরকারের নয় মন্ত্রীসহ ১৩ জন আসামিকে। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত সেই ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি দলটির প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীরা।