ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা বললেও বাস্তবে অদূর ভবিষ্যতে সেটা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের মধ্যেই। বিষয়টি ধরা পড়ে বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের ভার্সাইয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর বৈঠকে।
বৈঠকে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস সহ জ্বালানি খাতের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা কাটানোর বিষয়টি আলোচনা হলেও তা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি ইউরোপীয় নেতারা। বিশেষ করে রাশিয়ার তেল গ্যাস কয়লা রফতানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় যে এখনই অংশ নিচ্ছে না ইউরোপ তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার।
ভার্সাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর দুই দিনের সম্মেলনে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা হ্রাসের ঘোষণা সম্বলিত বিবৃতি আসলেও এ ব্যাপারে কোনো দিনক্ষণ কিংবা সময় সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। যদিও একটি নির্দিষ্ট সময় সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়টিই ছিলো আলোচনার অন্যতম এজেন্ডা।
আরও মজার ব্যাপার হলো কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশ চাচ্ছে এই সময় সীমাকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করতে, আবার কেউ কেউ তা বাড়াতে চাচ্ছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। ইইউ এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এর মানে দাঁড়ায় এই সময় সীমার মধ্যে অবাধে রাশিয়ার তেল গ্যাস কিনবেন তারা। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যা খুশি করুক না কেন।
এ পরিস্থিতিতে ফের স্বস্তির সুবাতাস বইছে বিশ্বের তেলের বাজারে। চার দিনের ব্যবধানে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি কমে এসেছে ২৭ ডলার পর্যন্ত। অথচ সোমবার রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পরপরই অপরিশোধিত তেলের দাম উঠে গিয়েছিলো ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউরোপীয় দেশগুলোও এই নিষেধাজ্ঞায় সামিল হবে এই আশঙ্কায় হঠাৎ করেই চড়ে যায় তেলের বাজার। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞায় তাদের সামিল না হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরপরই নামতে থাকে তেলের দামের পারদ।
সোমবার অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্টক্রুড এক পর্যায়ে ১৩৯ ডলারে উঠে গেলেও মঙ্গলবার তা নেমে আসে ১৩০ ডলারের নিচে। বুধবার তা নেমে আসে ১২০ ডলারের নিচে। আর বৃহস্পতিবার তা বিক্রি হয় প্রতি ব্যারেল ১১৭ ডলারে। আর সর্বশেষ শুক্রবার প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড বিক্রি হচ্ছে ১১২ ডলারে।
এছাড়া অপর আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটও নেমে এসেছে প্রতি ব্যারেল ১১০ ডলারের নিচে। শুক্রবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তা অবস্থান করছিলো প্রতি ব্যারেল ১০৯ ডলারে।
কেন রাশিয়ার তেল গ্যাসের কাছে জিম্মি ইউরোপ?
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক যে ইউরোপীয় দেশগুলো অনুসরণ করবে না বোঝা যাচ্ছিলো ইউক্রেন সঙ্কটের প্রথম থেকেই। কারণ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল তারা।
ইইউভুক্ত দেশগুলোর মোট গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ এবং তেল আমদানির ২৭ শতাংশ এবং কয়লা আমদানির ৪৬ শতাংশ নির্ভর করে রাশিয়ার ওপর।
এই শীতের মধ্যে হঠাৎ করে রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দিলে তা নজিরহীন সঙ্কট তৈরি করবে পুরো ইউরোপজুড়ে। এ পরিস্থিতি ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে।
সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানায়। এই আহ্বানে আরব আমিরাত সাড়া দিলেও এখনও সাড়া দেয়নি সৌদি আরব। এছাড়া তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক জানিয়েছে রাশিয়ার সরবরাহ করা বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাসের কোনো বিকল্প আপাতত তাদের হাতে নেই।
অপরদিকে রাশিয়ার তেলের বিকল্প হিসেবে ভেনেজুয়েলা এবং ইরানের সঙ্গে ফের শীতল সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ওয়াশিংটনের সে চেষ্টাতেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
প্রতিদিন বিশ্ববাজারে ৭০ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে থাকে রাশিয়া। যার বেশির ভাগের গন্তব্যই ইউরোপ। সৌদি আরবের পর রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রফতানিকারক।
এছাড়া রাশিয়ার তেলের ওপর ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ইউরোপ গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেয় মস্কো।
এই হুমকির পরপরই তড়িঘড়ি করে ইউরোপীয় দেশগুলো জানায় তারা এখনই রাশিয়ার তেল রফতানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে না।
এর বদলে ইইউ দেশগুলো তাদের দেশে রাশিয়ার কোটিপতিদের ব্যক্তিগত ইয়ট এবং বিলাসবহুল ভিলাগুলো জব্দ করার কার্যক্রমে মনোযোগ দিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার তেল রফতানিতে খুব একটা ক্ষতি হবে না। কারণ রাশিয়া থেকে খুব কম তেলই আমদানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় গন্তব্য ইউরোপ ও চীন। এমনকি ইউরোপ রাশিয়ার তেল নিষিদ্ধ করলেও চীনের কাছে সহজেই এই তেল বেঁচতে পারবে রাশিয়া।
রাশিয়ার তেল না কিনলে ক্ষতি ইউরোপেরই
বিশ্ববাজার থেকে রাশিয়ার তেলকে নিষিদ্ধ করলে তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে অস্বাভাবিক হারে। এমনকি তেলের দাম উঠে যেতে পারে ব্যারেল প্রতি তিনশ ডলারেও।
ফলে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা শুধু রাশিয়াকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে মূল্য দিতে হবে ইউরোপকেও। ইতোমধ্যেই রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নোভাক বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া নর্ডস্ট্রিম-১ পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে।
আর এই শীতে নিজেদের নাগরিকদের ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া থেকে বাঁচানো ইউরোপের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ইউক্রেন ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তা তো সহজেই বোঝা যায়।