বিজয় দিবসে স্মৃতির আড়ালে স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন

জাতীয়

ডিসেম্বর ১৬, ২০২২ ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ

মতিউর রহমান সরকার দুখু,ঢাবি প্রতিনিধি

জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও জাতীয় জাদুঘরের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে চিনে এবং জানে এমন লোকের সংখ্যা নেহাত হাতেগোনা। অনন্য এই অমর স্থাপনার পেছনে লুকিয়ে আছে স্থপতির এক করুণ ইতিহাস। প্রতিবছর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান‌ বাংলাদেশ ভ্রমণকালে ও আপামর জনতা স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। যার মেধা ও মননে আমরা পেয়েছি বীরত্বগাথা এই স্মৃতিসৌধ তাকে আমরা ক’জনই বা মনে রেখেছি।

১৯৫২ সালের ৫ মে ঢাকার বিক্রমপুরে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার দামপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। পিতা সৈয়দ মুজিবুল হক ছিলেন কলেজশিক্ষক ও মাতা সৈয়দা রাশিদা হক ছিলেন গৃহিণী। বাবার চাকরির সুবাদে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় প্রথম শ্রেণীতে পাশ করেন। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলেও বেশিদিন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেননি। ফলে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেও বড় পদে প্রমোশন পাননি।

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সাভারে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে ৮৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরবর্তী ধাপে ১৯৭৬ সালে এই প্রকল্পের জন্যে প্রতিযোগিতামূলক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে স্থাপত্য সজ্জা আহ্বান করা হয়। প্রথমবার কোনো প্রতিযোগী নির্বাচিত হতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার প্রতিযোগিতায় ৫৭ টির মতো নকশা জমা পড়ে। এদের মধ্যে মাইনুল হোসেনের নকশাটিকেই নির্বাচকমণ্ডলী গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। সাত সংখ্যাটির একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে স্মৃতিসৌধের নকশাটি আঁকেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমশঃ বড় করে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি কেন এই ধারণাটিকে কাজে লাগালেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সাতটা বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল। সবচেয়ে নিচের খাঁজটা বায়ান্ন, সবচেয়ে উঁচুটা একাত্তর।” এছাড়া তাকে নকশার সম্মানি বাবদ টাকা দেয়া নিয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। স্মৃতিসৌধের নকশার সম্মানী বাবদ তাঁর ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ এক লাখ টাকা। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তদবির করে তিনি করের হার কমাতে পেরেছিলেন, শেষ পর্যন্ত কর দিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। স্মৃতিসৌধের নকশা করার কারণে তাকে বিভিন্ন মহল থেকে হত্যার হুমকি দেয়াসহ মানসিক চাপে রাখা হয়। যার ফলে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জটিল মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। একসময় তাঁর পরিবার তাকে ছেড়ে চলে গেলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। শান্তিনগরে নানার পুরাতন একতলা বাড়িতে জীবনের বাকিটা সময় নিংসঙ্গভাবে কাটান খ্যাতিমান এই স্থপতি। জীবদ্দশায় তিনি মাত্র কয়েকবার নিজের অমর স্থাপনা স্মৃতিসৌধ দেখতে পেরেছিলেন। তিনি শান্তিনগরের অন্ধকার ঘরটিতে মশার কামড় খেয়ে দিনরাত পার করতেন। এরপরও বাইরে বের হতেন না। বাইরে বের না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, কোনো এক অজানা আড়াল থেকে তাঁকে নিষেধ করা হয়, ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেওয়া হয়। সৈয়দ মাইনুল হোসেন স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে বলেন, “ওটার আয়ু কম হবে। কারণ জেনারেল এরশাদের বিশেষ নির্দেশে ওটার নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছিল খুব তাড়াহুড়ো করে। এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন কয়েক মাস আগে। সারা দেশ তাঁর বিরুদ্ধে, বিন্দুমাত্র সমর্থন কোথাও নেই। তাই তিনি চাইছিলেন পরবর্তী ১৬ ডিসেম্বরে(১৯৮২ সালের) জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সহানুভূতি-সমর্থন লাভ করতে। তাড়াহুড়োতেই নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৫০ ফুট উচ্চতার স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন। সেই অনুষ্ঠানে স্থপতি মইনুল হোসেনকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। পরে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পূর্তমন্ত্রী বলছিলেন, “দুঃখিত, তাঁর কথা আমাদের মনেই ছিল না”। অনুষ্ঠানের দিন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চলে যাবার পর সৈয়দ মাইনুল হোসেন জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তাঁর অমর সৃষ্টি।

১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৈয়দ মাইনুল হোসেন ৩৮টি বড় বড় স্থাপনার নকশা করেছেন৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জাতীয় স্মৃতিসৌধ (১৯৭৮),বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (১৯৮২), ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট,বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন (১৯৭৮),চট্টগ্রাম ইপিজেড এর অফিস ভবন (১৯৮০),শিল্পকলা একাডেমীর বারো’শ আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম,ভোকেশনাল ট্রেনিং ইস্টিটিউট (১৯৭৭),উত্তরা মডেল টাউন (আবাসিক প্রকল্প ) (১৯৮৫)।
দেশের অন্যতম খ্যাতনামা এই স্থপতির জীবনের শেষ বছরগুলো অবর্ননীয় দুঃখ ও অর্থাভাবে কাটে। একবেলা খাবারের জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। এরূপ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় ২০১৪ সালের ১৪ই নভেম্বর ৬২ বছর বয়সে মারা যান সৈয়দ মাইনুল হোসেন। জীবনের এতো অমর কীর্তির সম্মানটুকু দিতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্র। পরবর্তীতে ২০২২ সালে স্থাপত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে রাষ্ট্র তার অপরিশোধিত ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করে। এছাড়াও তিনি একুশে পদক (১৯৮৮) ও শেলটেক পদক (২০০৭) লাভ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *