কোটার আধিপত্য থেকে সাধারণ মেধাবীদের স্থায়ী নিস্তার হোক

শিক্ষা

জুলাই ৭, ২০২৪ ৯:৪১ অপরাহ্ণ

তন্ময় দাস ( পবিত্র) , নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি :

সাধারণত,বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস এর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের মেধা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে। মেধা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অর্থপূর্ণতা হলো আপনার চিন্তাশক্তি, বোধশক্তি, জ্ঞান গভীরতা, ব্যবহারিক সক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি থাকবে যেটাকে কাজে লাগিয়ে প্রশিক্ষণ, উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথাযথ পারদর্শিতা নিশ্চিত হবে যার মাধ্যমে ন্যায্য, নিরপেক্ষ এবং উন্মুক্ত নিয়োগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। এই ব্যবস্থাপনার বাইরে আপনার দৈহিক গঠন, বংশ,বর্ণ,ধর্ম, সম্প্রদায়,আপনার সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি এসবের কোন বিশিষ্টতাই মেধা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অর্থপূর্ণতা নেই।

আর এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটা বিষয়টা হলো সেই বিষয় যেখানে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যধারী ব্যক্তিবর্গের বিশেষ অবস্থানের (soft tools) মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান। তার মানে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থী/চাকুরী প্রার্থীদের পর্যাপ্ত মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঐ সকল বিশেষ গ্রুপদের জন্য নির্দিষ্ট অবস্থান সংরক্ষিত করা হচ্ছে যেটা একটা প্রকাশ্য বৈষম্য।
কোটা পদ্ধতি(যেটা দেশ ও জনসাধারণদের জন্য হুমকি),এই প্রকাশ্য বৈষম্যকে একধরনের স্বজনপ্রীতি/Nepotism বলা যেতে পারে ।

আমরা জানি যে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে (বিশেষ শ্রেণী) এগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে কোটা ধারনার উদ্ভব হয় যেটা একটি দেশ এবং জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর হবে ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
এই অনুচ্ছেদের ২৯ এর (৩) এর (ক) (খ) (গ) তে বলা হয়েছে, নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব, ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত শ্রেনীর নিয়োগ সংরক্ষণ এবং বিশেষ প্রকৃতির করনে নারী পুরুষের নিয়োগ সংরক্ষণ,সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।

চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। যার ফলে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল থাকবে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিন্তু প্রজাতন্ত্রের নিয়োগে ব্যক্তিস্বার্থ উন্মেষ হবে, জনসাধারণের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না । বিশেষ স্বার্থ হাসিল জন্য বিভ্রান্তিকর বৈষম্যমূলক কোনো বিধিমালা তৈরি হোক সেটা আমরা সাধারণ প্রার্থীরা মানিনা………

এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে , একটা বিশেষ শ্রেণী হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা তাহলে কেন তারা তাদের আত্মত্যাগের অবদান স্বরূপ প্রজাতন্ত্রের নিয়োগলাভে কোটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না ??

হ্যাঁ তারা অবশ্যই বিশেষ এবং বিশেষভাবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এখন আমাদের প্রশ্ন হলো তারা কেন আমাদের কাছে বিশেষভাবে সম্মানিত?? কারণ, তারা তাদের মেধা,দক্ষতা, সাহসিকতা,বীরত্ব,ত্যাগ, আত্মবিশ্বাস,আত্নবিসর্জন, মানবতা এবং দেশপ্রেম দিয়ে আমাদের দেশ ও জাতির সম্মান ,নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন। তাদের এ অবদান অমূল্য………

তারা সাম্য,সুবিচার এবং মানবিক মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের অহংকার,আমাদের আদর্শ। তারা সর্বোচ্চ সম্মানের, খেতাব যোগ্য । তাদের সম্মানসূচক পুরস্কৃত করা যেতে পারে । কোনোকিছুর বিনিময়ে তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতিদান সম্ভব নয় । যদি বিনিময় দেওয়া যেত তাহলে নিশ্চয় আত্মত্যাগ, দেশপ্রেমের গর্ব,অমরত্ব কিছুই থাকত না। কোটার মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্তা হিসেবে যদি তাদের সংরক্ষিত প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয় তাহলে এটা কখনই গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না । সেটা কখনই বীরের জাতির বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে না বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তিস্বার্থকেই ফুটে তোলে ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায়, সুযোগ্য নেতৃত্বে, ১৯৯৬ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রবর্তিত দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বর্তমানে সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য সম্মানী ভাতা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে।পরবর্তিতে, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা বৃদ্ধিসহ ‘মুজিববর্ষের উপহার’ হিসেবে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (MIS) সাহায্যে ‘জিটুপি’ পদ্ধতিতে ভাতার প্রচলন করেছে।
গৃহ নির্মাণ সহ রাষ্ট্রীয় সুবিধা গুলো দিয়েছেন। বীরের উত্তরাধিকারী হিসেবে তারা এই বিশেষ সুযোগ সুবিধা গুলো পেতেই পারেন । কিন্তু এরপর যা হয়েছে হচ্ছে সেটা সাধারণ প্রার্থী এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা মেনে নিতে পারিনা। নাতি-নাতনীরা কিভাবে এই সুবিধা লাভ করতে পারে এটা অযৌক্তিক এবং অতিরঞ্জিত বিষয়। মুক্তিযোদ্ধারা কি তাদের পরিবারের বিশেষ স্বার্থ ভোগের আশায় এদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ! সেটাতো নয় তাহলে প্রজাতন্ত্রের কর্তা হিসেবে নিয়োগে বিশেষ অবস্থান ( স্বজনপ্রীতি কোটা) আশা করছেন এটা খুবই বিব্রতকর, লজ্জাজনক বিষয় নয় কি! যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনী হিসেবে আপনারা নিজেদের কলঙ্কিত করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ,আত্নপর আত্মত্যাগকে অসম্মানিত করছেন,অমর নয় ।

মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার পরিজন যে ই হোক সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো তাদের মেধা,দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন বিশেষ কোটায় আসতে চাচ্ছে ! কারণ তারা সাধারণ মেধাবীদের সাথে প্রতিযোগিতায় নিয়োগলাভে অকৃতকার্যের শঙ্কায় ভুগছেন, তারা কী তাহলে একধাপ পিছিয়ে! জাতি হিসেবে আমরা বাপ,দাদা,মামা,খালুর আধিপত্য,কৃতিত্ব,প্রভুত্ব দ্বারা পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি । অথচ একজন আদর্শিক সুশিক্ষিত, সুনাগরিকের উচিত হবে উত্তরাধিকার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের কৃতিত্বে পরিচিত হওয়া।

গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা হিসেবে মেধা যোগ্যতাকে প্রমান করার আত্নপ্রত্যয়,আত্মবিশ্বাস,সাহসিকতা এবং সক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে কিভাবে একটা দেশের,জাতির নেতৃত্ব দেবে! যে বিশেষ শ্রেণী/ যে বীরের জাতিই হোন না কেন তাদের আদর্শিক মেধা , দক্ষতা দিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করুক সাধারণ প্রার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে । তাহলে বীরের জাতি হিসেবে তাদের সম্মান ,বীরত্ব আরও সুউচ্চ হবে , দেশ ও জাতির কর্ণধার হবেন তারা ।
সবাইকে কেন সরকারি আমলাই হতে হবে! বিশেষ/অনগ্রসর জাতির অনুকূল প্রতিনিধিত্ব নামের প্রহসনে টেনে হিঁচড়ে একটা শ্রেণীকে সাধারণ প্রার্থীদের চেয়ে তুলনামূলক কম মেধাবীদের সরকারি নিয়োগে পদাধিকার দিয়ে ‘Economic man’ পাওয়া ছাড়া পাব্লিক সার্ভিসের সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক তেমন কোন ফলাফল বয়ে আনবে না।
আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব হচ্ছে পিরামিড আকৃতি যেখানে কতিপয় দক্ষ, বিচক্ষণ এবং মেধাবী নেতৃবৃন্দ জনসাধারণের নীতি নির্ধারক এবং সেবক হবে। কোটার মাধ্যমে মেধাহীন নেতৃত্ব নিয়োগ করলে পুরো প্রশাসনিক সিস্টেমটাই ভারসাম্যহীন হবে ।

একদল স্বার্থন্বেষী জাতিকে কোটার কারণে একধাপ এগিয়ে দিতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে উল্টো দুইধাপ পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে । তাদের যে মেধা , দক্ষতা দিয়ে প্রতিযোগিতায় আসতে না পেরে কোটায় এসেছে , এই যে একটা গ্যাপ তৈরি হচ্ছে । অন্যদিকে তারা প্রগতিশীল টেকশই জনসেবা দিতে পারবেনা এবং মেধা শূন্য জাতি আস্তানা তৈরি করবে । কোটা পুনর্বহাল মানেই হচ্ছে অতীতকে টেনে ভবিষ্যত নষ্টের গোঁড়ামি যার ফলে আত্নপ্রত্যয়ী মেধাবীরা নিস্তেজ, আশাহত হবে এবং মেধার অবমূল্যায়ন হবে।

আমাদের জনসাধারণের সার্বিক সুবিবেচনায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটা পদ্ধতি স্থায়ীভাবে বাতিল হোক।
তবে যদি দেশ এবং জাতির বিশেষ স্বার্থে, গনতান্ত্রিক সমর্থনে কোনো বিশেষ বর্ণ,ধর্ম,সম্প্রদায়কে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোটায় পদায়নের প্রয়োজন হয় তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ব্যতীত অন্য শ্রেনীতে সেটা সব মিলিয়ে ৫%এর কম হওয়া উচিত। যেমন প্রতিবন্ধী কোটা যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে পিছিয়ে (তবে তাদের এটাও নৈতিকতা, আদর্শতা,মেধা, দক্ষতার পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে অভিযোগ,আপত্তি,চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার আত্নপ্রত্যয় নিয়ে জনগনের সেবায় আসা উচিত)।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে কোটা সমর্থিত জাতির কাছে আমার প্রশ্ন থেকেই যায় যে,


যেসকল কোটাধারী প্রার্থীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্তা হিসেবে নিযুক্ত হবেন তাদেরকে কি আমরা Public Servant বলব নাকি Special quota servant বলব?


Public policy and Public service এর ক্ষেত্রে তাদের অবদান কেমন হবে? [ যেহেতু জনসাধারণের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে অনঢ়]

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন এত এত কনসেপ্ট,থিওরি এবং গভর্ন্যান্স, গণতন্ত্র,সুশাসন,জন তত্ত্ব মহৎ ব্যক্তিত্ব,শাশ্বত বাণী,সততা,নৈতিকতা,জনসেবা,দেশপ্রেম, সমতা,ন্যায্যতা ,স্বচ্ছতা শেখায়?এসবের প্র্যাকটিস কোথায়? পূর্বপুরুষের কৃতিত্বেই যদি নীতি নির্ধারক(আমলা) হওয়ার পথ সহজসাধ্য হয় সাধারণ মেধাবীদের জায়গা কোথায়?

আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধা ,সক্ষমতার ঘাটতি থাকলে হেরে যেতে পারি কিন্তু কোটার আধিপত্যে মেধার অবমূল্যায়নে হেরে যেতে রাজি নই।
আমরা চাই মেধা,দক্ষতা,স্বচ্ছতার নামে কোটায় নিয়োগ প্রতারণা বন্ধ হোক। সর্বোপরি, বৈষম্যমূলক নিয়োগ ব্যবস্থা স্বায়ীভাবে নির্মূল হোক।

লিখেছেন : তুসিফা সুলতানা তুসি, এম.এস. এস. শিক্ষার্থী, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *