ইসরাইলি বাহিনীর ‘বিভীষিকাময়’ অভিযান এবং জেনিনবাসীর লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা

ইসরাইলি বাহিনীর ‘বিভীষিকাময়’ অভিযান এবং জেনিনবাসীর লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা

আন্তর্জাতিক

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪ ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন সেজা বাওয়াক্নেহ নামের এক ফিলিস্তিনি নারী। কয়েক বছর আগে তার বাবা ইসরাইলি বাহিনীর হাতে এখানেই নিহত হয়েছিলেন। সম্প্রতি আবারও সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

এবার তিনি অপেক্ষা করছিলেন একজন ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তার সিগনালের জন্য। যাতে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা শহরের প্রধান হাসপাতালটিতে যেতে পারেন।

জেনিনে চালানো ১০ দিনের নৃশংস অভিযানের সময় ইসরাইলি বাহিনী তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। পাঁচ দিন পরে অবশ্য তারা নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেন।

তখন রাত ১টা, সেজা তার ৬০ বছর বয়সি মা, দুই বোন, গর্ভবতী ভাবি এবং ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিল কেবল শিশুদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি ছোট ব্যাগ এবং পরনের কিছু কাপড়।

বাওয়াক্নেহ পরিবারের বাড়িতে এর আগেও বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে জেনিনে এবারের অভিযানটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। শহরবাসী একে ‘ভূমিকম্পের’ সঙ্গে তুলনা করে বর্ণনা করেছে। এ অভিযানে অন্তত ৩৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে এবং ইসরাইলি বাহিনীর বুলডোজার শহরের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দিয়েছে।

১০ দিনব্যাপী এ অভিযান গত শুক্রবার প্রত্যাহার করে নেয় ইসরাইলি বাহিনী।

২৯ বছর বয়সি সেজা বাওয়াক্নেহ বলেন, ‘সাধারণত আমাদের হেঁটে ১০ মিনিট সময় লাগে হাসপাতালে পৌঁছাতে। কিন্তু সেদিন রাস্তা ও বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষের কারণে এবং আমরা হাত উপরে তুলে ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম- এজন্য আমাদের অনেক বেশি সময় লেগে যায়’।

প্রথমে বন্দি, পরে বাস্তুচ্যুত
গত ২৮ আগস্ট শুরু হওয়া ভয়াবহ এ অভিযানের পর, বাওয়াক্নেহ পরিবার তাদের চারতলা বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। এটাই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। কারণ বাইরে ইসরাইলি স্নাইপাররা অবস্থান করছিল। পাঁচ দিন ধরে তারা সেখানেই আটকে ছিলেন এবং বাড়িতে যতটুকু খাবার, পানি ও ওষুধের ব্যবস্থা ছিল- তা দিয়েই জীবনধারণ করছিলেন।

অভিযানের পঞ্চম দিনে ইসরাইলি বাহিনী এক ঘণ্টা ধরে গুলিবর্ষণ করে। এর পর তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। সেজা বলেন, ‘আমরা সবাই রান্নাঘরের এক কোণে গাদাগাদি করে এবং গুটিসুটি মেরে বসেছিলাম। চারপাশে বোমা, গুলির শব্দ এবং মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল’।

তিনি জানান, ইসরাইলি সেনারা তাদের ঘরে ঢোকার পর, তারা বাওয়াক্নেহ পরিবারকে বাইরে চলে যেতে বলে। সেজা প্রথমে রাজি হননি। কারণ তিনি শিশুদের জন্য রাস্তায় বের হওয়া নিরাপদ মনে করেননি। এতে সেনারা ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের একটি ঘরে আটকে রাখার হুমকি দেয় এবং তাদের মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর এক সেনা এসে তাদের ঘর থেকে বের করে দেয় এবং রাতের অন্ধকারেই তাদের চলে যেতে বলে।

সেজা বলেন, ‘আমরা তখন নিশ্চিত করি যে বাচ্চারা তাদের পোশাক পরে নিয়েছে এবং তাদের পায়ে জুতাও আছে। আমরা তাদের তাড়া দিচ্ছিলাম চলে যাওয়ার জন্য, কারণ সেনারা আবার যে কোনো মুহূর্তে ফিরতে আসতে পারে’।

সেদিনে ভয়াবহ পরিস্থিত স্মরণ করে ২৯ বছরের এই ফিলিস্তিনি নারী বলেন, ‘শিশুরাসহ আমরা সবাই ভীত ছিলাম এবং বাচ্চারা আমাদেরকে শক্ত করে ধরে রাখছিল। তাদের পা এত বেশি কাঁপছিল যে তারা হাঁটতে পারছিল না’।

সেজা আরও বলেন, ’যখন তারা রাত ১০টার দিকে আমাদের বাড়িতে আসে, তখন তাদের সংখ্যা ছিল ’অবিশ্বাস্য’ পরিমাণে এবং তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর নিয়ে প্রতিটি ঘরে তল্লাশি করছিল’।

তিনি বলেন, ‘সেনারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও খাবার নিয়ে এসেছিল, যা অভিযানের দিনগুলোর জন্য যথেষ্ট ছিল। তখন আমরা নিশ্চিত হই যে, তারা আমাদের বাড়িটিই ‘সামরিক ঘাঁটি’ হিসাবে ব্যবহার করতে যাচ্ছে’।

ফিলিস্তিনি এই নারী আরও বলেন, ‘এ সময় আমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমরা যে এই অন্ধকারের মধ্যে একাকী হেঁটে যাবো, তারা আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে কিনা? জবাবে এক অফিসার হ্যাঁ বললেন। আসলে এ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না। পরে আমরা চলে গিয়েছিলাম এবং তারা আমাদের সঙ্গে করে একটি জিনিসও নিতে দেয়নি। আমাদের কাছে খাবার, পানি, কাপড়, টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না।

জেনিন সরকারি হাসপাতালে পৌঁছানোর পর, সেজা বাওয়াক্নেহ দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের পরিস্থিতি অন্যান্য অনেক পরিবারের মতোই ছিল। যারা তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং যাদের জীবন হাসপাতালেই শেষ হয়ে গেছিল।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এবং ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের অভাবে গোটা শহরে কী ঘটছে- তা জানার কোনো উপায় ছিল না। পাশাপাশি শরণার্থী শিবির এবং শহরের পূর্ব অংশ জুড়ে যা ঘটছে, তাও বোঝার কোনো উপায় ছিল না।

ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর
সেজা বলেন, পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন প্রচুর সংখ্যায় আসতে শুরু করে এবং তাদের উপস্থিতিতে হাসপাতালের আঙ্গিনায় রীতিমত ঢল নামে।

এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর প্রাণঘাতী এ অভিযান ‘ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো’। যার ফলে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতিও অনিবার্য।

এ বিষয়ে একমত পোষণ করে জেনিন পৌরসভার প্রধান নিদাল আল-ওবাইদি বলেন, ‘এ অভিযানকে আমি ভূমিকম্পের সঙ্গেই তুলনা করব। কারণ ইসরাইলি বাহিনী বুলডোজার দিয়ে শহরের বাড়ি-ঘর ও রাস্তাগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। এছাড়াও পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছে। স্কুল, খেলার মাঠ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। প্রায় ৭০ শতাংশ শহর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে’।

ইসরাইলি বাহিনীর এ অভিযানে অন্তত ১২০টি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ১০০টিরও বেশি দোকানপাট ধ্বংস হয়েছে। বাওয়াক্নেহ পরিবারের বাড়িটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ বিষয়ে সেজা বলেন, ‘আমাদের বাড়ির প্রতিটি কোণ তছনছ হয়ে গেছে। এটি পুনরায় বসবাসযোগ্য করতে কয়েক সপ্তাহ লাগবে’।

এদিকে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) বলেছে, তাদের বেশ কয়েকটি দলের সদস্যরা জেনিন এবং এর শরণার্থী শিবিরে আটকে পড়া লোকদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তার ব্যর্থ হয়েছে। লোকেরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কারণ ইসরাইলি বাহিনী তাদের সব ধরণের অধিকারে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। অনেকেরই খাবার, পানি, শিশুখাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কম ছিল।

স্থানীয় সাংবাদিক ইমান সিলাউই জানিয়েছেন, ইসরাইলি সৈন্যরা শরণার্থী শিবিরের কেন্দ্রস্থলে বাণিজ্যিক স্কোয়ারটি কোণঠাসা করেছে এবং এটিকে একটি ‘সংরক্ষিত সামরিক অঞ্চল’ ঘোষণা দিয়েছে।

স্থানীয় ওই সাংবাদিক বলেছেন, এ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে শরণার্থী শিবিরের ১২ হাজার বাসিন্দার একটি অংশই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। যারা পালিয়ে গেছে তারা শহরের উপকণ্ঠে বা শিবিরের এমন এলাকায় চলে গেছে, যেখানে সংঘর্ষ কেন্দ্রীভূত ছিল।

যদিও শিবিরের পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে অ্যাড-দামজের​আশেপাশের এলাকা থেকে কয়েক ডজন লোককে ইসরাইলি সৈন্যরা জোর করে বের করে দিয়েছে। অন্যান্য হাজার হাজার পরিবার ক্যাম্পে থেকে গেছে।

এর কারণ হলো তারা হয় নিরাপদে চলে যেতে পারেনি। কেননা সহজভাবে তা করার উপায় নেই।

সহায়তা না পেয়ে আশা হারাচ্ছে মানুষ
আল-ওবাইদি জানান, জেনিনের জনগণ বরাবরই ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় থেকেছে। তবে এবার ধ্বংস ও অনিশ্চয়তার বড় ধরনের মাত্রা তাদের আশা ভেঙে দিয়েছে।

এ বিষয়ে সেজা বলেন, ‘আমরা খুবই ক্লান্ত। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এবং শরণার্থী শিবিরের লোকজন কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। ফলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আশা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে’।

মূলত এ ভয়াবহ সংকটের মধ্যে থাকা পরিবারগুলো এখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আছে। কিন্তু কোনো রকমের সহায়তা ছাড়া নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবেন না অনেকেই।

(আল জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্ববনে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *